কক্সবাজার, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প, ৩ মাসে ১৮ খুন

দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে মাদক, ধর্ষণ ও অপহরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খুনোখুনির মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ। অভ্যন্তরীণ বিরোধ, দলাদলি ও প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে কেবল গত তিন মাসেই হত্যার শিকার হয়েছেন ১৮ জন রোহিঙ্গা। এখন খুনিদের টার্গেটের শীর্ষে রয়েছেন ক্যাম্পের পাহারাদার মাঝিরা।

বর্তমানে ক্যাম্পে এক ডজনেরও বেশি সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি গ্রুপের হাতেই রয়েছে ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের মজুত। হত্যাসহ বহুমাত্রিক অপরাধে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, গত তিন মাসে কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে খুন হয়েছেন ১৮ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা অর্থাৎ মাঝি রয়েছেন। আর গত পাঁচ বছরে সবমিলিয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন ১শ’ ১৮ জন।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ভোর ৪টার দিকে কুতুপালং ১৭ নম্বর ক্যাম্পের সি ব্লকে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে। নিহতরা হলেন-কুতুপালং ১৭ নম্বর ক্যাম্পের সি ব্লকের বাসিন্দা কেফায়েত উল্লাহর ছেলে আয়াত উল্লাহ ও মোহাম্মদ কাসিমের ছেলে ইয়াছিন। গত ২৬শে অক্টোবর ভোররাতে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা উখিয়ার দশ নম্বর ক্যাম্পের এফ-১৬ ব্লকে প্রবেশ করে এফসিএএন (নং ৬০০৮৩৪)-এর শেল্টার থেকে মোহাম্মদ জসিম (২৫) নামে এক রোহিঙ্গা যুবককে ডেকে বের করে। তারপর ব্লকের একটি গলিতে এনে তার বুকে পরপর তিন রাউন্ড গুলি ছুড়ে।

 

ঘটনাস্থলেই জসিমের মৃত্যু নিশ্চিত করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। তার আগে ২৫শে অক্টোবর দিবাগত রাতে উখিয়ার কুতুপালং দুই নম্বর ক্যাম্পে মোহাম্মদ সালাম (৩৭) নামে এক যুবককে গুলি করে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে উখিয়ার এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে চিকিৎসাধীন সালাম এখনো শঙ্কামুক্ত নয় বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। তার আগে গত ১৫ই অক্টোবর সন্ধ্যায় উখিয়া বালুখালী ১৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ১৮ নম্বর ব্লকে দুই রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা হেড মাঝি মো. আনোয়ার ও ব্লক মাঝি মৌলভী মো. ইউনুসকে কুপিয়ে হত্যা করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এর দু’দিন পর গত ১৮ই অক্টোবর দিবাগত রাতে উখিয়ার ১৯ নম্বর ক্যাম্পে অজ্ঞাতনামা এক সাধারণ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। এ নিয়ে চলতি মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই মাঝি, এক শিশুসহ সাত রোহিঙ্গা নিহত হলেন। সূত্র মতে, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে।

আবার রোহিঙ্গারা যে ত্রাণ পায়, তা কারা কিনে বাইরে বিক্রি করবে তা নিয়েও বিরোধ রয়েছে। গত বছরের ২৯শে সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে উখিয়ার লাম্বাশিয়া আশ্রয়কেন্দ্রের ডি ব্লকে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) নামের সংগঠনের কার্যালয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান মাস্টার মহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার পর থেকে খুনোখুনি লাগামহীন হয়ে উঠেছে। এখন ক্যাম্পে কেউ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কথা বললেই তাকে হত্যার জন্য টার্গেট করা হচ্ছে। সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো ভারী অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি ক্যাম্পের ভেতরেই অস্ত্র তৈরি করে। তাদের সঙ্গে মিয়ানমারের মাদক এবং অস্ত্র চোরাচালানিদের যোগাযোগ আছে। তাদের সঙ্গে জড়িত রয়েছে কিছু স্থানীয় লোক। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে প্রত্যাবাসনবিরোধী সন্ত্রাসীদেরকে গোপনে মিয়ানমার সরকার মদত দিচ্ছে বলেও অভিযোগ অনেক সাধারণ রোহিঙ্গার। কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২০শে আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরনের অপরাধে মোট দুই হাজার চারশ’ ৩৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা পাঁচ হাজার দুইশ’ ২৬ জন। এই পাঁচ বছরে অস্ত্র জব্দের ঘটনায় একশ’ ৮৫টি, মাদক জব্দের ঘটনায় এক হাজার ছয়শ’ ৩৬টি, ধর্ষণের অভিযোগে ৮৮টি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় বা আদায়ের চেষ্টার অভিযোগে ৩৯টি মামলা হয়েছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরনের অপরাধে মোট দুই হাজার চারশ’ ৩৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা পাঁচ হাজার দুইশ’ ২৬ জন। এই পাঁচ বছরে অস্ত্র জব্দের ঘটনায় একশ’ ৮৫টি, মাদক জব্দের ঘটনায় এক হাজার ছয়শ’ ৩৬টি, ধর্ষণের অভিযোগে ৮৮টি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় বা আদায়ের চেষ্টার অভিযোগে ৩৯টি মামলা হয়েছে।

পাঁচ বছরে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে একশ’ ১০টি। এসব খুনের ঘটনায় আরও একশ’ হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে ছয়টি। খুনোখুনি ছাড়াও আরও যেসব অপরাধে মামলা হয়েছে তার মধ্যে আছে অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, মানব পাচারসহ ১২ ধরনের অপরাধ। এর মধ্যে চলতি বছরের গত আগস্ট পর্যন্ত মাত্র এক বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরনের অপরাধে মামলা হয়েছে এক হাজার একশ’ ৪০টি। এই সময়ে অস্ত্র জব্দের ঘটনায় ৯৮টি, মাদক জব্দের ঘটনায় আটশ’৭৪টি, ধর্ষণের অভিযোগে ২৩টি এবং খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩০টি। তার মানে সর্বশেষ এক বছরে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় মামলার সংখ্যা তুলনামূলভাবে বেশি।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন বা এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সশস্ত্র সংঘাতের কারণে কিছু সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারী জিরো লাইন থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে নাশকতা চালাচ্ছে। তারা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মাঝিদের টার্গেট করে হত্যা করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের তিনটি ইউনিট কাজ করছে। সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। ক্যাম্পে বাড়তি নজরদারি আরোপ করা হয়েছে।

পাঠকের মতামত: